
ক্যাপ্টেন (অব:) আজিজুল হক বীরপ্রতীক।। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ৬নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেস উদ্দিনের অধিনে যুদ্ধে যোগদান করি। যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ১১ সেপ্টেম্বর/৭১ইং আমার পিতা মরহুম ছখি উদ্দিন আহমেদ বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যু বরণ করেন। আমি আমার পিতার ১ম পুত্র হয়েও তার নামাজে জানাজায় উপস্থিত থাকতে পারিনি। সেসময় আমি ভ‚রুঙ্গামারী-বাঘভান্ডার ডিফেন্স লাইনে ছিলাম। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে আমি ডিউটি চেক করে ২.০০ টার সময় ক্যাম্পে ফিরে সংবাদ পাই যে, কমান্ডার সাহেব আমাকে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টারে (সাহেবগঞ্জ) ডেকে পাঠিয়েছেন। দুপুরের খাবার শেষে সুবেদার বোরহান আমাকে বার বার হেড কোয়ার্টারে যাবার জন্য তাগিদ দিচ্ছিলেন। আমি হেড কোয়ার্টারের দিকে রওনা দিয়ে বিকেল ৫.৩০ ঘটিকায় হেড কোয়ার্টারে পৌঁছি। গেটে প্রবেশকালে স্যান্ট্রি জানালেন “স্যার, আপনার Father মারা গেছেন, আপনার ভাই একরামুল টেলিফোন করেছিলেন।” কমান্ডারের নির্দেশে আমি ভারতীয় ট্রাকে চড়ে কুচবিহারের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। রাত ১০.০০ টায় আলিপুর দুয়ারে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ীতে উঠি। আমার আত্মীয়স্বজন রাতে আমাকে যেতে না দেয়ায় সকালে আমার পরিবারের আশ্রয়স্থল চালকর গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে সকাল ১০.০০ টায় পৌঁছাই। সেখানে পৌঁছে শুনি রাত ১১.০০ টায় আমার পিতার জানাজা হয়ে গেছে। আমার পরিবারের সঙ্গে ২/৩ দিন অবস্থান করে কুলখানি শেষে সাবসেক্টর হেড কোয়ার্টারে ফেরৎ আসি।
আমার পিতার মৃত্যুর ২ মাস পর নভেম্বরের ১২ তারিখ সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর নওয়াজেস সাহেব আমাকে ডিফেন্স লাইন থেকে রাত ১১.০০ টায় ডেকে পাঠিয়ে আমার কুশলাদি জানলেন এবং একটি বিশেষ অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হলো।
কুড়িগ্রাম-ভ‚রুঙ্গামারী রোডের বর্তমান নাগেশ্বরী উপজেলার সন্তোষপুর নামক স্থানে সড়ক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য অপারেশন ম্যাপ দেখানো হলো। সন্তোষপুরে মুক্তিযোদ্ধার ২টি সেকশন অবস্থান করছিল। এক সেকশন কমান্ডারের নাম নুরুল হক সরকার এবং অপর সেকশনের দায়িত্বে ছিলেন মঞ্জুরুল ইসলাম। প্রয়োজনীয় আর্মস এমুনেশন নিয়ে সেকশন ২টির সঙ্গে যোগাযোগ করে নাগেশ্বরী-ভ‚রুঙ্গামারী সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ দেয়া হলো, যাতে করে পাক সেনা নাগেশ্বরী হতে ভ‚রুঙ্গামারী ও ভ‚রুঙ্গামারী হতে নাগেশ্বরী যেতে না পারে। নভেম্বরের ১৩ তারিখ বিকাল ৩.০০ টায় আমাকে তৎকালীন মেজর ডাঃ এম. এম. হোসেনের (পরবর্তীতে ডিজি, সি.এম.এইচ) শ্যালক মুক্তিযোদ্ধা বাবু মোটর সাইকেলযোগে সন্তোষপুরে পৌঁছে দেন। সেদিন অপারেশনস্থল রেকি করার পর সন্ধ্যায় একটি ছোটখাটো অপারেশন করা হয়। এই অপারেশন করতে গিয়ে ২// মর্টার চালক আহত হয়। সেখানে মর্টার চালানোর মত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কেউ না থাকায় আমি আহত মর্টার চালকের নিকট থেকে মর্টার পরিচালনা করার কারিগরি কৌশল শিখে নেই। আহত মর্টার চালককে হাসপাতালে পাঠানোর পর আমি মর্টার পরিচালনার দায়িত্ব নেই এবং তা আমার সঙ্গেই রাখি।
১৪ তারিখ দিনের বেলা যেখানে সড়ক বিচ্ছিন্ন করা হবে সে জায়গাটি রেকী করার পর রাত আনুমানিক ৯.০০ ঘটিকা হতে অপারেশনের কাজ শুরু করি। প্রথমে ১টি বড় আম গাছে মাইন চার্জ করে গাছটিকে রাস্তার উপর ফেলা হয় এবং রাত ১২.০০ টার দিকে হাই এক্সপ্লোসিভ মাইন দিয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট রাস্তা কাটঅফ করা হয়।
পরের দিন ১৫ তারিখ সকাল থেকে আমরা অবজারভেশনে ছিলাম। বিকাল ৩.০০ টার দিকে ভ‚রুঙ্গামারীর উদ্দেশ্যে পাক আর্মির একটি ট্রাক অপারেশনস্থলে রাস্তায় Obstacle দেখে থেমে যায় এবং রাস্তাটি পুনরায় চালু করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। আমরা তখন ২// মর্টার, LMG, SLR, Riffle দিয়ে তাদের উপর আক্রমণ চালাই। একটানা ৩ টা থেকে ৫ টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। সন্ধ্যায় তারা নাগেশ্বরীর দিকে ফিরে যায় এবং আমরা আমাদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসি। রাত আনুমানিক ৮.০০ টায় স্থানীয় এক ব্যক্তি ক্যাম্পে এসে জানান “আপনাদের ফায়ারিংয়ে ১ জন পাক আর্মি মারা গেছে, আমাদের বাড়ীর পার্শ্বে রক্তাক্ত অবস্থায় তার লাশ পড়ে আছে।” তিনি আমাদেরকে ঘটনাস্থলে যাবার অনুরোধ করেন। আমরা তাকে পাক বাহিনীর চর হিসেবে সন্দেহ করে তার সঙ্গে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। আমরা তাকে বলে দেই যে, আপনি যান আমরা পরে আসতেছি।
১৬ তারিখ সকাল আনুমানিক ৭.৩০ টায় আমি গোলা বারুদ লোড না করে ২// মর্টার নিয়ে ১ জন সৈনিক সহ ঘটনাস্থলের দিকে যাই এবং একজনকে LMG, একজনকে SLR, দুইজনকে Riffle ও একজনকে ২// মর্টারের গোলা নিয়ে আমাদের পিছনে আসতে বলি। ধান খেতের পাশ দিয়ে আমরা কাটঅফকৃত রাস্তায় উঠি। গোলাবারুদ ও অস্ত্র বহনকারী ৫ জন আমাদের বেশ কিছু দূর পিছনে ছিলেন। আমরা স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় অপারেশনকৃত রাস্তাটি অনেক গভীর করে গর্ত করার প্রস্তুতি নেই। এমন সময় আমার এক সহযোদ্ধা দেখতে পান যে, ২জন পাক সেনা রায়গঞ্জ হতে ধান খেতের ভিতর দিয়ে আমাদের দিকে মেইন সড়ক অভিমুখে আসতেছে। তিনি আমাকে ডেকে দেখান স্যার, ২জন খান সেনা আমাদের দিকে আসতেছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই ২জন খাকি পোশাকধারী পাক সেনা পাকা ধানের রংয়ের সঙ্গে মিশে আমাদের দিকে আসতেছে। আমার সহযোদ্ধা পাক সেনা দু’জনকে দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। কারণ আমাদের কাছে তখন শুধু গোলা বারুদ বিহীন অস্ত্র ছিল। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, “তুমি ঘাবড়াবে না, চুপ চাপ দেখ আমি কি করতেছি।” এ বলে আমি আমার ২// মর্টারটি হ্যান্ড গার্ড পজিশনে নিলাম এবং উচ্চ স্বরে বলতে লাগলাম “কোন হায় আগে বার্নেকা কোশিষ মত্ কর” অর্থাৎ কে আছ আগে আসার চেষ্টা করো না। “এক কদম হিলেগা তো গুলি করদেগা” অর্থাৎ এক পা আগালে গুলি করে দিব। এ কথাগুলো দুই তিন বার রিপিট করি। আমি উর্দূ ভাষা ভাল ভাবে ও কিছু কিছু পাঞ্জাবী ভাষা বলতে পারতাম। আমার কথাগুলো খান সেনারা হয়তো বুঝতে পেরেছে। তারা এক পা দু’পা করে আমাদের দিকে আসতে থাকে। আমি আবারও উচ্চ স্বরে বললাম “হিলো মত্ আগার হিলেগা তো গুলি করদেগা” অথাৎ নড়বে না, নড়লেই গুলি করব। কিন্তু এদিকে আমার কাছে ২// মর্টারের ব্যারেল ছাড়া আর কিছুই নেই। আমার মনের সাহস ছিল প্রবল। আমি নিজে বিচলিত হই নাই। পাক পিড়িয়ডে আমার এক ওস্তাদ আমাদের ট্রেনিং দেন যে, দোশমন কো কভি পিঠ মত দেখাও, মরনা হায়তো ছিনাছে মরো অর্থাৎ শত্রæকে দেখে কখনো পালাবার চেষ্টা করবে না, মরলে বীরের মত মর। আমার সে মুহুর্তে ওস্তাদের কথাটি মনে পড়ে। আমি এও ভাবলাম আমার পিতা ভারতে মারা গেল, যদি আমি মারা যাই তবে আমার লাশ হয়তো বাংলাদেশে ফিরবে না। আমি তখন মনস্থির করলাম যে, যদি মরি বীরের মত মরব, পালাবার চেষ্টা করব না। কারণ, আমি পালালে আমার সহযোদ্ধারা সহ আমাদের পিছনে মাটি খননের কাজে নিয়োজিত নিরস্ত্র সাধারণ জনগন নিশ্চিত মারা যাবে। আমার শেষোক্ত নির্দেশের পর দেখলাম ১জন খান সেনা অস্ত্র নিচে রাখল, অপরজন অস্ত্র রাখছে না। আমি আবারও বললাম, “দোনো আর্ম গ্রাউন্ড কর, মেরা পাছ আজাও” অর্থাৎ ২ জনেই মাটিতে অস্ত্র রেখে আমার কাছে আস। দু’জনেই অস্ত্র নিচে রাখল। আমি পুনরায় বললাম “হাত উপর করকে অ্যাডভান্স কর” অর্থাৎ হাত উপর করে অগ্রসর হও। দুজনে হাত উপর করে আমার কাছে আসল। একজন আমার হাত ধরে বলল, “আপ লোক কোন হায়” অর্থাৎ আপনারা কারা। আমি উত্তরে কৌশলে বললাম “হাম রাজাকার হায়” অর্থাৎ আমরা রাজাকার। সে আবার বলল- “আপ লোক ইধার কিয়া কররাহে” অর্থাৎ আপনারা এখানে কি করতেছেন। উত্তরে বললাম, “দেখো শালা মুক্তিলোকনে রাস্তা খারাপ কর দিয়া, নাগেশ্বরী মে লেফটেন্যান্ট ছাহেব নে হাম লোককো রাস্তা ঠিক করনেকা অর্ডার দিয়া, ইছি রাস্তাছে কানবাই আনে ওয়ালা হায়, ভুরুঙ্গামারী মে এ্যাটাক করনা হায়” অর্থাৎ শালা মুক্তিরা রাস্তা খারাপ করে দিয়েছে, নাগেশ্বরী হতে লেঃ সাহেব আমাদেরকে রাস্তা ঠিক করতে অর্ডার দিয়েছে। এ রাস্তা দিয়ে ভ‚রুঙ্গামারী আক্রমণ করার জন্য কনভয় আসবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক বাহিনীতে নতুন অফিসার লেফটেন্যান্ট হতে ক্যাপ্টেন পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে পাঠানো হতো। এ ধারণা করে আমি লেফটেন্যান্ট এর কথা বলি। তাদের একজন আমাকে একজন লেফটেন্যান্ট এর নাম বলে বলল ওহিং লেঃ ছাব হায় না নাগেম্বরী মে? খান সেনারা যার নাম বলল আমি তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বললাম “হাঁ ওহিং লেঃ ছাহাব নাগেশ্বরী মে হায়।” খান সেনারা আমাদের বলল “হাম লোককো লেঃ ছাহাব কা পাঁছ পৌঁছাইয়ে” অর্থাৎ আমাদের কে ঐ লেঃ এর নিকট নিয়ে যান। তারা কতজন আছে জিজ্ঞাসা করলাম “আপ লোক কেতনা আদমী হায়।” উত্তরে তারা বলল “হাম লোক দো আদমী হায়, রাতকো জো ফায়ার হোয়া সব আদমী ভাগগিয়া হাম লোক নয়া আদমী, রাস্তা নেহি জানতে, ভাগনে নেহীছেকা” অথাৎ রাত্রে যে গোলগুলি হয়, তখন সবাই পালিয়ে যায়, আমরা নতুন রাস্তা জানা ছিল না বলে পালাতে পারিনি। তখন আমি তাদের কোমরে হাত দিয়ে দেখলাম তাদের নিকট কোন গ্রেনেড আছে কি না। কারণ যুদ্ধের সময় প্রত্যেক সৈনিককে আত্মরক্ষার জন্য ২টি করে গ্রেনেড ইস্যু করা হয়। গ্রেনেড না থাকায় তাদের কোমরে বাধা চাইনিজ পোজ এমুনেশনের বালিয়ার খুলে নিলাম। দেখলাম তাতে চাইনিজ রাউন্ড ভর্তি করা ছিল। আমার সঙ্গী এক মুক্তিযোদ্ধাকে ইশারা করলাম পিছনে ফেলে আসা খান সেনাদের অস্ত্র ২ টি নিয়ে আসতে। তিনি অস্ত্র নিয়ে এস বললেন, অস্ত্র এনছি স্যার। যে মুক্তিযোদ্ধাটি অস্ত্র আনলেন তার কাছে ছিল S.L.R। খান সেনা ২টি S.L.R দেখে বলল “ইয়ে হাতিয়ার তো মুক্তি কা হায়” অর্থাৎ এই অস্ত্র তো মুক্তিযোদ্ধাদের। খান সেনাদের ভয় পাওয়ার কারণ হলো যুদ্ধের সময় S.L.R থাকত শুধু ভারতীয় সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট, পাক সেনাদের কোন S.L.R ছিলনা। আমি খান সেনাদের আশ্বস্থ করে পাঞ্জাবী ভাষায় বললাম “আলাকা তোম লোক ঘাবড়া গিয়া? ইছে হাতিয়ার হামলোক মুক্তিছে কব্জা কিয়া” খান সেনা দুজন আমার কথায় আশ্বস্ত হলো। তারা মনে করল আমরা তাদের লোক। তাই তারা আমাদের বলল “হাম লোক দোদিন ছে কোছ খায়া নেহি, আপলোক কা কেম্প মে লে জাইয়ে কুছু খানেকা দিজিয়ে” অথাৎ আমরা দুই দিন থেকে কিছু খাইনি, আপনাদের ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের জন্য কিছু খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আমার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধাটি পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন, তিনি ছুটিতে আসার পর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনিও উর্দু বলতে পারতেন। তিনি বললেন- “খোদাকি কছম হাম লোক আপলোককো হামারা কেম্প মে লে জাইংগে ঘাবড়াও নেহি”। ইতিমধ্যেই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে। একজনকে রশি আনার জন্য বললাম। রাস্তার পাশেই একটি ছাগল বাঁধা ছিল। ছাগলটি ছেড়ে দিয়ে রশি আনা হলো। রশি দিয়ে যেই খান সেনাদের হাত বাঁধতে যাচ্ছি, তারা বলল “আপ লোক কেয়া কর রহে” অর্থাৎ আপনারা কি করতেছেন। তখন খান সেনাদের বললাম, “শালে লোক জানতে হো হাম লোক কৌন হায়? হাম লোক রাজাকার নেহি হায়, হাম লোক মুক্তি হায়। জয় বাংলা বোলো” অর্থাৎ আমরা রাজাকার নই, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। তাদেরকে জয় বাংলা বলতে বলায় তারা বলল “জয় বাংলা কেয়া হায়” অর্থাৎ জয় বাংলা কি? অমনি দু’জনের গালে স্বজোরে চড় মারলাম। এরপর আর কাউকে মারতে দেই নাই। জানি, এরা দু’জনতো একরকম মরেই গেছে, তাদেরকে আর মেরে কি হবে। এই ভেবে তাদের চোখ হাত বেঁধে নিয়ে আসতেছি। তখন সকাল সাড়ে নয়টা বা দশটা হতে পারে। খান সেনা ধরার খবর পেয়ে চৌধুরীরহাট হাই স্কুলের ছাত্ররা প্রত্যেকের হাতে লাঠি নিয়ে খান সেনাদের মারার জন্য দল বেঁধে আসতেছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে আমরা রাস্তা বেরিকেড দিলাম যাতে ছাত্ররা কিছু করতে না পারে। খান সেনাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য চৌধুরীর হাট B.S.F ক্যাম্পে তাদের রেখে আমি সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর হেড কোয়ার্টারে আসি। সেক্টর কমান্ডার বাশার সাহেব ও সাব-সেক্টর কমান্ডার নওয়াজেস সাহেবকে বিস্তারিত ঘটনা জানাই এবং খান সেনা দু’জনকে আনার জন্য একটি গাড়ি চাই। তারা দু’জনেই আমাকে এই কাজের জন্য প্রশংসা করলেন। পাশাপাশি আমাকে সাবধান করে দিলেন এরকম সাহস যেন আর না দেখাই। পরে আমাকে একটি জীপ গাড়ী দিলেন। আমি খান সেনা দু’জনকে B.S.F ক্যাম্প থেকে নিয়ে হেড কোয়ার্টারে পৌঁছিয়ে দেই। এরপর তাদেরকে W.P (ওয়ার প্রিজনার) হিসেবে জেলে পাঠানো হয়। আমি সেদিন দেখেছি মৃত্যুর আগে মানুষের অবস্থা কেমন হয়। আটককৃত খান সেনারা জানত তাদের নিশ্চিত মৃত্যু। তাদের দু’চোখে অঝরে পানি পড়ছে আর যত রকম কলেমা আছে তারা পাঠ করছে।
জীবিত ২খান সেনা ধরাপড়ার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যান আসেন। ফটো তোলেন, সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন, ভারতের কয়েকটি পত্রিকায় ছবিসহ সংবাদও ছাপা হয়। পরে যুদ্ধের মোড় এগুতে থাকে, এ সমস্ত সংবাদ রাখার আর চেষ্টা করি নাই।
যে দু’জন খান সেনাকে সশস্ত্র অবস্থায় আটক করা হয়েছিল তাদের একজন ৪৮ফিল্ড আর্টিলারী কোরের সিপাহী আতা মোহাম্মদ এবং অপরজন ২৫পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সিপাহী আসলাম খান নেওয়াজী। দু’জনের নিকট থেকে ২টি ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেল ও ৪০০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত চাইনিজ রাইফেল ২টির মধ্যে একটির নম্বর ছিল ০৫৪৯২। ১৫ তারিখে পাক সেনাদের সঙ্গে গোলাগুলির সময় তাদের ফেলে আসা গগএ এর গুলি ১১১০ রাউন্ড, ৭.৬২ চাইনিজ রাইফেলের গুলি ১৯৪০ রাউন্ড ঐ স্থান হতে উদ্ধার করা হয়।
এই ঘটনার ৪ দিন পর অর্থাৎ ২০/১১/১৯৭১ ইং ছিল আমাদের ঈদ-উল-ফিতরের দিন। ঐদিন আর এক হৃদয় বিদারক ঘটনা আছে। ঈদের দিন সকালে লেঃ সামাদ শহীদ হন।
—————————————-
ক্যাপ্টেন (অব:) আজিজুল হক বীরপ্রতীক
বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজ সেবক
রামকৃষ্ণ মিশন রোড, লালমনিরহাট